Skip to main content
Article Bengali Swami Brahmananda
স্বামী ব্রহ্মানন্দ
স্বামী ব্রহ্মানন্দ
শ্রীরামকৃষ্ণ-মানসপুত্র

রাজা মহারাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রবন্ধ

রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের স্বামী ব্রহ্মানন্দ - স্বামী সুবিরানন্দ

।। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের স্বামী ব্রহ্মানন্দ ।।

স্বামী সুবীরানন্দ

 

আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় : শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দ। T.S. Eliotএর একটি কথা আছে “a lifetime burning in every moment”. আমরা পূজনীয় রাজা মহারাজকে ভাবনেত্রে যখন অবলোকন করি, কথাটির যাথার্থ্য অনুভব করি । রাজা মহারাজকে এক কথায় বলা যায়- ‘অধ্যাত্ম মন্দাকিনী’- a flow of spirituality.

শ্রীরামকৃষ্ণের একটি অদ্ভুত দর্শন হয়েছিল, অবশ্যই ভাবচক্ষে । পঞ্চবটীতলে একটি সুন্দর, কোমল বালক দাঁড়িয়ে আছে । এর অর্থ কি? এই দর্শনের কি তাৎপর্য? কয়েকদিন পরে মহামায়া, জগন্মাতা ভবতারিণী আরেকটি দর্শনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করে দিলেন-- পূর্বোক্ত দর্শনের তাৎপর্য উদ্ভাষিত করে দিলেন । শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবচক্ষে দর্শন করলেন—শ্রীশ্রী জগদম্বা মনোরম দর্শন একটি শিশুকে তাঁর ক্রোড়ে বসিয়ে দিলেন । বললেন : “এইটি তোমার পুত্র!” শ্রীশ্রীঠাকুর ত্যাগ ও বৈরাগ্যের বাদশা । ওঁর তো সাংসারিক নিয়মে কোন পুত্র লাভ করবার কথা নয় । ভবতারিণী বুঝিয়ে দিলেন, এটি তাঁর মানসপুত্র-- The spiritual son. শ্রীশ্রী ঠাকুর স্মরণ করলেন, উনিই একদিন ব্যাকুল চিত্তে মহামায়ার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন-- “মা একজনকে সঙ্গী করে দাও আমার মতো । মা আমার তো সন্তান হবে না, কিন্তু ইচ্ছা করে একটি শুদ্ধসত্ত্ব ছেলে আমার সঙ্গে সর্বদা থাকে। সেইরূপ একটি ছেলে আমায় দাও।” এই ছেলেটিই ব্রজের রাখাল –- স্বামী ব্রহ্মানন্দ । আর ধরাধামে অবতীর্ণ হবার জন্য কৃষ্ণসখা এই শিকড়া-কুলীনগ্রামের পুণ্যভূমিকেই বেছে নিয়েছিলেন। ধন্য শিকড়া-কুলীনগ্রাম, ধন্য আধুনিক যুগের ব্রজবাসী, শিকড়া-কুলীনগ্রামের অধিবাসীবৃন্দ।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভগবানের অবতার। “পূর্ব পূর্ব অবতার এলো কলাংশে যাঁহার। স্বয়ং সে দক্ষিণেশ্বরে এসেছে এবার।” শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ প্রমুখ অবতার পুরুষদের বাদ দিলে অধিকাংশ অবতারের মধ্যেই ঈশ্বরের আংশিক শক্তির প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু এবারে শ্রীরামকৃষ্ণরূপে ঈশ্বরের পূর্ণ আবির্ভাব । পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণ তিনি। তাঁর নিজের কথায় : যে রাম, যে কৃষ্ণ, ইদানিং এই শরীরে তিনিই রামকৃষ্ণ” আর মর্ত্ত্যলীলার অন্তিম অধ্যায়ে রাজা মহারাজ কি  বলছেন ?

“এই যে পূর্ণচন্দ্র! রামকৃষ্ণ! রামকৃষ্ণের কৃষ্ণটি চাই। আমি ব্রজের রাখাল, দে দে, আমায় ঘুঙুর পরিয়ে দে। আমি কৃষ্ণের হাত ধরে নাচব। ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম। কৃষ্ণ এসেছে, কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কি সুন্দর আমার কৃষ্ণ --কমলে কৃষ্ণ, ব্রজের কৃষ্ণ!”

যথার্থই মানসপুত্র- “Like father, like son” বাপকা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া, কুছ ভি নেহি তো থোরা থোরা।” Christ বলেছিলেন : “one who has seen the son has seen the father”. তাই ঠাকুরের মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা শ্রীশ্রী ঠাকুরকেই দর্শন করেছেন, ঠাকুরের অবর্ত্তমানে রাজা মহারাজের মধ্যে ঠাকুরের প্রতিচ্ছবি ওঁরা দেখতে পেতেন। তাই মহারাজকে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ পদে অভিষিক্ত করে স্বামীজী ওঁকে অর্থাৎ শ্রীশ্রীঠাকুরের এই প্রতিমাকে প্রণাম করে বলেছিলেন : “গুরুবৎ গুরুপুত্রেষু”

‘‘অদ্যাপি ও সেই লীলা করেন গৌর রায়।

কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।।’’

রাখাল মহারাজ সেরকম একজন লীলা সহচর। শ্রীরামকৃষ্ণের শুদ্ধসত্ত্ব মানসপুত্র রাখালকে নিয়ে যশোদারূপী শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও বা বাৎসল্যরসের ভাবগঙ্গা বইয়ে দিয়েছেন ভবতারিণীর আঙ্গিনায় অথবা যশোদা-কৃষ্ণ সম্পর্কের re-enactment ­­­­­- পুনরভিনয় যুগধর্ম প্রবর্তনে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। জননী যশোদার নয়নের মণি রাখালরাজ শ্রীকৃষ্ণ অতি সুন্দর পবিত্র শিশু। শ্রীরামকৃষ্ণের আদরের ধন রাখাল চির-বালক। তাই শ্রীশ্রী ঠাকুর স্নেহমাখা কন্ঠে বলেছেন : “রাখালের দোষ ধরতে নেই ।”

ভজন-আরাধনায় তুষ্ট ব্রজবিহারী অহেতুকী কৃপা করে দেব-শিশু উপহার দিয়েছেন -- এই বিশ্বাস ছিল কৈলাস কামিনীর। তাই পুত্রের নাম রেখেছিলেন ‘রাখাল’।

শ্রীশ্রীঠাকুরের পার্ষদদের মধ্যে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীরূপ বিহঙ্গটিই শ্রীরামকৃষ্ণরূপ মাস্তুলে এসে প্রথম বসেছিলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে -- নরেন সম্পর্কে ঠাকুরের ভাবমুখে আমরা শুনতে পাই -- তিনি অখণ্ডের ঘরের সপ্তর্ষির অন্যতম । নরঋষির অবতার। রাখাল সম্পর্কেও ভাবস্থ, সমাধিস্থ, আনন্দময় পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন -- গঙ্গাবক্ষে শতদল কমলের ওপর কৃষ্ণকিশোরের সঙ্গে নৃত্যরত একটি বালক । “নরেন্দ্রকে দেখিয়া এক্ষণে চিনিতেছি- নরেন্দ্রই সেই ঋষি।” রাখালকে দেখেও চিনেছিলেন এই সেই পূর্বদৃষ্ট বালক। ব্রজের রাখাল। মহারাজ ছিলেন রামকৃষ্ণের দ্যোতক -- রামকৃষ্ণময়। তাই স্বামী সারদানন্দজী বলছেন, “তাঁহার মতো অপর কেহই ঠাকুরের পূতসঙ্গ করেন নাই ।” দক্ষিণেশ্বরে এলে শ্রীশ্রীঠাকুর ও শ্রীশ্রীমা শশব্যস্ত হয়ে পড়তেন রাখালের সাচ্ছন্দ্যবিধানের জন্য । একবার রাখালকে যে Special treatment দেওয়া হয়, এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী স্বয়ং উত্তর দিয়েছিলেন “রাখাল যে ছেলে ।”একদিন রাত্রে ঠাকুরের পিপাসা পেয়েছে। কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দিতে বললেন রাখালকে। রাখাল বিছানা ছেড়ে উঠলেন না। জল দিতে পারবেন না বলে দিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বিরক্ত হলেন না। উল্টে বললেন- “এখন বুঝেছি রাখাল আমাকে ঠিক ঠিক বাপ বলেই জানে ।” পরিশেষে সর্বপূজ্য রামলালদাদার মুখে আমরা শুনি –- মানসপুত্র রাখাল সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব ও আবেগের কথা। ঠাকুর রাখালকে পান সাজতে বললেন। রাখাল মুখের উপর ‘না’ বলে দিলেন। ঠাকুরের উপরোধ বারংবার প্রত্যাখাত হতে দেখে লাটু মহারাজ তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করলেন। রাখাল মহারাজ বললেন, “ তোর গরজ থাকে তুই সেজে নিয়ে আয় না। আমি পারব না। জীবনে ওকাজ কোনদিন করিনি, আজ ওনার আদেশে আমি পান সাজি আর কি!” এদের বাদানুবাদ ঠাকুর লক্ষ্য করলেন। তিনি রামলালদাদাকে বললেন : “ও রামনেলো! রাখাল-লেটোর যুদ্ধ দেখবি আয় রে!” ঠাকুর ব্যঙ্গচ্ছলে রামলাল দাদাকে জিজ্ঞাসা করলেন- “বল্ তো, কে বেশী ভক্ত, রাখাল না লেটো ? ” রামলাল বললেন- “ মনে হয় রাখালই বেশী ভক্ত।” ঠাকুর সহাস্যে তা সমর্থন করেছিলেন। শ্রীমায়ের ভাষায় : মহারাজ ছিলেন “ ফজলী আম ।” স্বামীজী বলতেন, ‘ঠাকুরের ছেলেরা সব Original.’ মহারাজ ছিলেন Original, স্বতন্ত্র। ওঁর ভাবের কোন ইতি নেই। স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর অন্যতম চরিতকার স্বামী প্রভানন্দজীর ভাষায় : “রসসৃষ্টিই তাঁহার অন্তরাত্মার সহজ প্রকাশ। আনন্দ বিতরণই তাঁহার গভীর উপলব্ধির অনিবার্য বিকাশ।”

 

স্বামী বিবেকানন্দের সহযোদ্ধা স্বামী ব্রহ্মানন্দ :

আমরা যখন বলি স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামী বিবেকানন্দের ‘সহযোদ্ধা’ ছিলেন, তখন কিন্তু আক্ষরিক অর্থে বা প্রচলিত অর্থে এই কথাটির প্রয়োগ আমরা করি না। আলংকারিক অর্থেই এর প্রয়োগ করে থাকি। স্বামীজী একটি চিঠিতে জীবনের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন  ”Life is struggle.” জীবন হচ্ছে “সংগ্রাম অপার”। উল্টো করেও বলা যায় ”Struggle is life”-- সংগ্রামেরই অপর নাম হচ্ছে জীবন। এই সংগ্রাম Micro level‘-এও হয়, Macro level‘-এও হয়--ব্যষ্টির জীবনেও হয়, সমষ্টির জীবনেও হয়। ব্যষ্টি জীবনে আভ্যন্তরীণ রিপুসমূহের সাথে সংগ্রাম আর সমষ্টি জীবনে বিপরীত দৃষ্টিকোণসম্পন্ন মানুষদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। স্বামীজী বললেন “Work is worship”- “শিব জ্ঞানে জীব সেবা”র কথা। অন্যপরে কা কথা, শ্রীরামকৃষ্ণের অনেক শিষ্যদেরই এই ভাব গ্রহণে দ্বিধা ছিল। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের এই Pet  theme টিকে কার্যকরী করতে  যাঁরা সহায়ক হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পুরোধা ছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ। তাই স্বামীজী ১৮৯৭ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে লিখছেন:

“I now understand that I have been very harsh to all of you. But I knew, however, that you would bear with all my shortcomings; in the Math there is no one else who will do so.” রাজা মহারাজের উপর স্বামীজীর কি অগাধ আস্থা ছিল! তাই স্বামীজী রাজা মহারাজকে নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছিলেন  “Kindly do my work for me, no question of success or defeat enters here at all. I have never retreated in a fight –-­­­ shall I now…….?” তার পরদিন স্বামীজী রাজা মহারাজকে আর একটি চিঠি লিখলেন। মঠ পরিচালনা, হিসাব-পত্র রাখার ব্যাপারে কিছু নির্দেশাদি দিয়ে। ঠাকুর বলতেন, ‘রাখাল আমার বাপ।’ ‘রাখাল একটা রাজ্য চালাতে পারে।’ এ ইঙ্গিত স্বামীজী বুঝেছিলেন। তাই ব্রহ্মানন্দজীকে তিনি মঠ-মিশনের অধ্যক্ষ করে গেলেন। ব্রহ্মানন্দজী সম্পর্কে স্বামীজীর মন্তব্য প্রনিধাণযোগ্য: “he is thousand times more spiritual than me. He is a living spiritual dynamo.”

স্বামী ব্রহ্মানন্দজী গুরুভ্রাতা স্বামী প্রেমানন্দ ও স্বামী যোগানন্দকে একদিন স্পষ্টভাবে তাঁর ভুমিকার কথা বললেন --

“আমি বৃন্দাবনে বেশ ছিলুম। যাতে মঠের ভিতর তাঁর সেই প্রেম-ভক্তিভাব জীবনে বিকাশ পায়, যাতে তোমাদের দেখে ঠাকুরের কথা সবাই স্মরণ করতে পারে তাই বৃন্দাবন ছেড়ে তোমাদের সেবা করতে এলুম।”

১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে আমেরিকায় যাত্রা করবার প্রাক্কালে হরিদাস বিহারীদাসকে লেখা স্বামীজীর কয়েকটি কথা এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য:

“As to the other two Swamis…………………….of them one is leader” স্পষ্ট ইঙ্গিত স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর প্রতি; স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে স্বামীজী রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার বহুদিন পূর্বে নেতার পদে বরণ করে নিচ্ছেন।

স্বামীজী আর এক পত্রে রামকৃষ্ণানন্দজীকে লিখছেন:

“রাখাল ঠাকুরের ভালবাসার জিনিস--একথা ভুলো না।”

পাশ্চাত্ত্য থেকে স্বামীজী যখন কলকাতায় পদার্পণ করলেন, হর্ষোৎফুল্ল মহারাজ পুষ্পমাল্যে গুরুভ্রাতা ও বাল্যবন্ধুকে বরণ করলেন। “গুরুবৎ গুরুপুত্রেষু” বলে স্বামীজী মহারাজের পাদস্পর্শ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মহারাজ “জ্যেষ্ঠভ্রাতা পিতৃসম” বলে স্বামীজীকে প্রতিপ্রণাম করলেন।

বিদেশে সংগৃহীত অর্থ স্বামীজী স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এদ্দিন যার জিনিষ বয়ে বেড়িয়েছি, আজ তাকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলুম।” ধীরে ধীরে আলমবাজার থেকে নীলাম্বর বাবুর বাড়ী, সেখানে মঠ প্রতিষ্ঠিত হল। এই মঠ ও মিশনের উদ্দেশ্য “বহুজন সুখায়, বহুজন হিতায় চ” এবং “আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ” রূপে নির্ণিত হয়। আর মঠ ও মিশনের অবিসংবাদিত নেতা রাজা মহারাজ যাঁর নেতৃত্বে দিকে দিকে নতুন শাখা কেন্দ্র হ’ল অথবা প্রাইভেট কেন্দ্রগুলো বেলুড় মঠের অনুমোদন পেল। স্বামীজী রাজা মহারাজকে বললেন:

“তুই যা বলবি তাই করবো। এমনকি তুই যদি আগাগোড়া সব বদলে দিতে চাস, তাই হবে।”

১৭/৭/৯৮ তারিখে স্বামীজী রাজা মহারাজকে লিখলেন:

“আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি যে আমার Policy ভুল, তোমারটিই ঠিকabout helping others.”

আবার রাজা মহারাজ বলতেন “এটি স্বামীজীর মঠ। তাঁর ইচ্ছানুসারে চলতে না পারলে মঠ ছেড়ে চলে যেতে পার।”

স্বামীজীর মহাসমাধির পর রাজা মহারাজ বললেন :

“সামনে থেকে যেন হিমালয় পাহাড় অদৃশ্য হয়ে গেল।”

“ঈশ্বরলাভই মনুষ্য জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য”-- ভগবান শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এই অমৃতময় বাণীকে মূর্ত্তরূপ প্রদান করবার জন্য এর উপায় স্বরূপ নর নারায়ণ সেবা আদর্শ দীর্ঘ সাতাশ বছর প্রয়োগ ও প্রচার করে ১৯২২ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দ তথা ব্রজের রাখাল ব্রজমণ্ডলে প্রত্যাবর্ত্তন করলেন।

আজ তাঁকে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই :

 

ওঁ কালিন্দী-ফুল্ল-কমলে মাধবেন ক্রীড়ারত।

ব্রহ্মানন্দ নমস্তুভ্যং সদ্গুরো লোকনায়ক ।।

শ্রীরামকৃষ্ণ-সান্নিধ্যে স্বামী ব্রহ্মানন্দ - স্বামী সুপর্ণানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণ-সান্নিধ্যে স্বামী ব্রহ্মানন্দ

স্বামী সুপর্ণানন্দ


শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বভাবের উৎস স্বরূপ ছিলেন। পরবর্তীকালে স্বভাবতঃই তাঁর যাঁরা পার্ষদ তাঁদের জীবনও সর্বভাবের মিলনভূমি হবে। হয়েছেও। তবু কোন কোন পার্ষদের ভিতর তাঁর কোন কোন বিশেষ ভাব প্রকাশ পেয়েছে। এটি হবার ফলে অনন্ত ভাবময় শ্রীরামকৃষ্ণের এক একটি ভাব ভক্তদের এবং মানবের গ্রহণ করতে সুবিধা হয়েছে। বস্তুতঃ শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বভাব একত্রে আমাদের মতাে সাধারণ মানবের জীবনে সমাদত হওয়ার সম্ভাবনাও; ; প্রয়ােজনও নেই। এ  জন্যই   তার এক একটি ভাব এক একজন পার্ষদের ভিতর সমধিক প্রকাশিত হয়ে- ধর্ম - পিপাসুদের ধর্মজীবনকে, করেছে।যেমন , স্বামী বিবেকান্দই কেবল শ্রীশ্রীঠাকুরের-ভাব - গুলিরই অধিকারী ছিলেন। এ-লীলাপ্রসঙ্গ - কারের। নৈকষ্যকুলীন স্বামী প্রেমানন্দে শ্রীমতী রাধারাণীর প্রেম জাগ্রত ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের মহাভাব প্রেম প্রেমানন্দকে আশ্রয় করেছিল বলে মনে করি আমরা। পুরুষকারের প্রমাণ মিলবে,  তুরীয়ানন্দ ,   অদ্ভুতানন্দ প্রমুখ পার্ষদদের জীবনে। তাঁরা তীব্র বিবেক-বৈরাগ্য নিয়ে সাধনায় রত ছিলেন। অন্যদিকে, স্বামী ব্রহ্মানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণলীলায় যে কি ছিলেন, কোন্ ভাবের পথিক ছিলেন, তা এককথায় বলা চলে না । তিনি রাখালচন্দ্রকে তাঁর সন্তান বলেই ভাবতেন এবং সেরকম ব্যবহারই তাঁর সঙ্গে করতেন—এ কথা বললেও কিছুই বলা হল না । ঠিক ঠিক বলতে গেলে, শ্রীরামকৃষ্ণ কখন যে বাল-গোপাল এবং কখন যে বালকের জননী যশোদা তা বোঝার উপায় নেই। মা ভবতারিণীই তাঁর সব; অথচ দক্ষিণেশ্বরে রাখালের সঙ্গে যে লীলা প্রকট হয়েছিল তা একান্তই বৃন্দাবনের।  গঙ্গাতীরে যেন যমুনা এলেন এবং শাক্ততীর্থ দক্ষিণেশ্বরে যেন বৃন্দাবনের, ফলে , জগদস্বাকে ঘিরে শ্রীরামকৃষ্ণের ভিতর অপূর্ব চিন্ময় বালকত্বের প্রকাশ ঘটল। আবার ঐ চিন্ময় বালক শ্রীরামকৃষ্ণকেই রাখাল,বসিয়েছেন , একাধারে রামকৃষ্ণ নিজে বালক এবং জননী।  যখন তিনি বালক সদানন্দময় শিশু তখন তিনিব্রহ্মানন্দজীর মধ্যেই তার লীলা খেলা করছেন।  তখন যেন দুটিই শিশু। আবার পরক্ষণেই তিনি, যশোদাভাবে মা হয়ে ঐ শিশুকেই ক্ষীর-ননি খাওয়াচ্ছেন, খেলা দিচ্ছেন , কাধে, "বলছেন , "(পাইলে আত্মহারা হইয়া রাখালের ভিতর যে কিরূপ বালকভাবের আবেশ হইত , তা বলিয়া বুঝাইবার নহে ( লীলাপ্রসঙ্গ দ্বিতীয়ভাগ)"৫৫ )" (আবার ( ঐপৃষ্ঠা ৫৪) বলছেন; “তখন রাখালের এমন ভাব ছিল—ঠিক যেন তিন চারি বৎসরের ছেলে। আমাকে ঠিক মাতার ন্যায়, থাকিতে , থাকিতেসহসাদৌড়িয়া আসিয়া ক্রোড়ে বসিয়া পড়িত এবং মনের আনন্দে নিঃসঙ্কোচে স্তন পান করিত।“ এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের শুনিয়েছেন, “আমাকে পাইলে” রাখালের ভিতর বালকভাবের আবেশ হত। কিন্তু তিনি আমাদের কাছে তাঁর নিজের ভিতর কোন্ ভাবের আবেশ হত রাখালকে পেলে, সে সংবাদ দেন নি। তা না দিলেও আমরা বেশ বুঝতে পারি তিনি স্বয়ং মা যশোদাই হয়ে যেতেন কখনও কখনও। আবার কখনও কখনও স্বয়ং বালক কৃষ্ণ। এ ভাব বোঝা সত্যই কঠিন।

ভূমিকাটি একটু দী্ঘ হাোল। তবে এ থেকে বেশ পরিষ্কার হয়েছে। কেন শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়োজন ছিল

ব্রহ্মানন্দজীকে। আবার অন্যদিকে, ব্রহ্মানন্দজীরই বেশ প্রয়োজন ছিল শ্ৰীরামকৃষকে, শ্রীভগবান আমাদের জগৎ গিতা, মাতা যে ভূমিকাটির সম্যক প্রতিষ্ঠা এবং প্রদর্শনের জন্য ব্রহ্মানন্দকে শ্ৰীরামকৃষ্ণের কাছে আসতে হয়েছিল।  আমরা সেই দিব্যলীলা পুনরায় অনুষ্ঠিত হতে দেখলাম এবং শ্ৰীরামকৃষ্ণের জীবনী এবং স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর জীবনীর মধ্যে তা লিপিবদ্ধ হয়ে আমাদের সমাজকে আধ্যাত্মিক সাধনার একটি সহজ সরল পথ সম্বন্ধে অবহিত করেছে। শ্রীভগবানের বাৎসল্য লীলা যে

কেমন হতে পারে তা যশোদা-গোপালের মধ্যেও এমনভাবে প্রকাশিত হয়নি। আমরা জানিনা- গোপাল যখন ১৭/১৮ বছরের যুবক এবং মথুরায় আছেন তখন ও যশােদার পক্ষ দিব্যলীলা পুনরায় অনুষ্ঠিত হতে দেখলাম শ্ৰীরামকৃষ্ণের জীবনী এবং স্বামী ব্ৰহ্মানন্দজীর জীবনীর মধ্যে তা লিপিবদ্ধ হয়ে আমাদের সমাজকে আধ্যাত্মিক সাধনার একটি সহজ সরল পথ সম্বান্ধে অবহিত করেছে। শ্রীভগবানের বাংসলয লীলা যে কেমন হতে পারে তা যশােদ-গােপালের মধ্যও এমনভাবে প্রকাশিত হয়নি। আমরা জানিনা- গােপাল যখন ১৭/১৮ বছরের বুবক এবং মথুরায় আছেন তখন ও যশােদার পক্ষে বাংসল ভাবের প্রকাশ করা সম্ভব কিনা। আমরা বলাতে চাইতার পক্ষেত্রজের গােপালকে খুঁজে পাওয়া আর কি সম্ব? আমাদের অনুমান সম্ভব নয়। আমাদের সে অনুমানও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে যশােদারপী শ্রীরামকৃষ্ণের রাখাল-লীলা দেখে। ১৮ বছরের যুবক তখন রাখাল-বিবাহিতও; কিন্তু কোন বিপুল মাতৃস্নেহের আকর্ষণে এবং আহবানে তিনি কোলে উঠে কাধে উঠে বাৎসল্য লীলা প্রকট করলেন- व আমাদের মনুষ্য বুদ্ধিতে বােঝা সম্ভব নয়। ছােট ছেলের মত তাকে খেলা দিতে হত। এক যুবকের পক্ষে শিশু হয়ে যাওয়া এবং এক প্রেট়ের পক্ষে মাতৃবৎ একং শিশুবৎ হয়ে যাওয়াদুটিই আমাদের কাছে বিশ্ময়। বন্দাবনলীলাও যেন স্তন্ধ হয়ে যায় এখানে।রাখালের সান্নিধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের আসা এবং শ্রীরামকৃষ্েের সান্নিধ্যে রাখালের আসা এযুগের পক্ষে বহু প্রয়ােজন ছিল। এর ফলে দুটি বড় লাভ হয়েছে আমাদের। এককৃষ্ণ এবং কৃষ্ণসখার মিলন দেখে আমরা বৃন্দাবন লীলায় সুস্নাত হতে পেরেছি। অনেক অবিশ্বাসীরও প্রত্যয়ে চিড় ধরেছে। দুইকৃষ্ণসখা রাখালের জন্য এবার যে বিশাল কর্মযজ্ঞ পড়ে রয়েছে। তারও সন্ধান পেলাম। রাখালরা তাঁর গােচারণের সঙ্গী। পরবর্তীকালেও তাই। স্বয়ং কৃষ্ণই রাজা হয়েছেন; রাজ্য পরিচালনা করিয়েছেন, করেছেন; রাজাও করেছেন। এখানে সেই রাখালদের একজন -সমগ্র পৃথিবীর আধ্যাত্মিক জাগরণের নেতৃত্বদিয়েছেন দীর্ঘ ২২ বছর ধরে। স্বামী ব্রহ্মানন্দের এই নেতৃত্বের পরিমাণ কাল-নিরপেক্ষ হয়ে রয়েছে। রামকৃষ্ণ মঠ এবং মিশন দৃঢ় পদক্ষেপে তাঁরই পরিচালনায় আজও আমাদের গর্ব হয়ে আত্মমােক্ষ এবং জগৎহিতে মানুষকে দেবতা করার কাজে নিয়ত যুক্ত। পরস্পরের সান্নিধ্য আমাদের সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁরা না এলে কী হত সে জল্পনায় কাজ নেই। শ্রীভগবানের প্রেরণায়, নির্দেশে তাঁরা মিলিত হয়েছিলেন। সে মিলনের প্রভাবের মধ্যেই আমরা লালিত-পালিত হচ্ছি । 

মানস পুত্ৰ , স্বামী অচিন্ত্যানন্দ

মানস পুত্ৰ 

স্বামী অচিন্ত্যানন্দ


    ‘মানসপুত্র’–বলেছিলেন জগন্মাতা, শুনেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

    মনে উঠেছিল ঠাকুরের : ‘মা, ইচ্ছে করে, একটি শুদ্ধসত্ত্ব ত্যাগী ভক্ত ছেলে, আমার কাছে সর্বক্ষণ থাকে'। তারই ফলে দেখেছিলেন দিব্য চক্ষে—মা একটি ছেলে এনে কোলে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এইটি তোমার ছেলে । সংসারী ভাবের ছেলে—ঠাকুরের কল্পনাতে কখনও ছিল না। তাই মায়ের কথা শুনে ঠাকুর শিউরে উঠেছিলেন। তাঁর ভাব দেখে মা হেসে বলেছিলেন, ‘সাধারণ সংসারী ভাবের ছেলে নয়, ত্যাগী মানসপুত্র।' ‘মানসপুত্র’ কথাটি মানুষের রচিত নয়, জগন্মাতার উচ্চারিত কথা। ঠাকুরের মন দিয়ে নিখুঁত ভাবে গড়া যেন এই ছেলে, তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন—ঠিক তেমনটি। তাই বুঝি মা বলেছিলেন, ‘মানসপুত্র'।

    পুত্র হয় পিতার সম্পদের অধিকারী। সাধারণ বিষয়ীদের সঙ্গে কথা বলে অস্থির হয়ে ঠাকুর চেয়েছিলেন এই পুত্র। কারণ বিষয়ীর মধ্যে নিজের ভাবের উত্তরাধিকারীর সন্ধান পাচ্ছিলেন না । যখন রাখাল এলেন তাঁর কাছে দক্ষিণেশ্বরে, তখন চিনতে পারলেন—‘এই সেই।'

    শ্রীশ্রীঠাকুরের কোলে বসিয়ে দিয়েছিলেন জগন্মাতা মানসপুত্রকে, যেমন শিশুপুত্রকে বসিয়ে দেয়। ঠাকুরের কোলে বসা—এই ভাব, শিশুপুত্রের ভাব, চিরকাল ছিল রাখালচন্দ্রের। ঠাকুরের কাছে যখন যেতেন, তখন তাঁর ঠিক যেন চার বছরের

    ছেলের ভাব হত। ঠাকুরকে মায়ের মতো দেখতেন। থেকে থেকে দৌড়ে গিয়ে তাঁর কোলে বসে পড়তেন। ঠাকুরকে পেলে, আত্মহারা হয়ে কী যে বালকভাবের আবেশ হ'ত, তা ব'লে বোঝাবার নয় । ঐ ভাব যে দেখত সেই অবাক হয়ে যেত। ঠাকুরও ভাবাবিষ্ট হয়ে তাঁকে ক্ষীর ননী খাওয়াতেন, খেলনা দিতেন, কখনও কখনও কাঁধে চড়াতেন। এসব সত্ত্বেও রাখালচন্দ্রের মনে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ হতনা। একবার মা ভবতারিণীর মন্দির থেকে প্রসাদী মাখন ঠাকুরের ঘরে এলে, ছোট ছেলের মতো, ব্রজের রাখালের মতো, রাখাল তুলে নিয়ে খেলেন। ঠাকুর তাতে বকলেন । বকুনি খেয়ে ছোট ছেলেরই মতো, তিনি ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলেন। চিরকালের জন্য ওরূপ করা ছাড়লেন। তা দেখে ঠাকুর বলতেন, ‘ওকে কিছু বলো না, ও দুধের ছেলে।' ঠাকুর যদি তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতেন, হিংসা হ’ত রাখালচন্দ্রের। তিনি তা সহ্য করতে পারতেন না। অভিমানে মন ভরে যেত তাঁর। ঠাকুর তাঁর সে ভাব দূর ক'রে দিয়েছিলেন।

    কোলের ছেলে যেমন নিশ্চিন্ত—মায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকে, সেই রকমই নিশ্চিন্ত—ঠাকুরের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন রাখালচন্দ্র। পিতার বন্ধন, পারিবারিক বন্ধন, বিষয়ের বন্ধন, কত বন্ধনই না ছিল তাঁর। কিন্তু ঠাকুরকে দেখার পর থেকে, সেসবের কোন চিন্তাই ছিল না তাঁর মনে। ঘুচে গেল ও সব অতি সহজেই, ঠাকুরের কৃপায় ।

‘শুদ্ধসত্ত্ব’ সংসারে থাকতে পারবেন না, তাই রাখাল চলে এলেন ঠাকুরের কাছে। ঠাকুরের কাছেই কাটালেন চিরকাল। কোনও প্রকার বিষয়বুদ্ধি স্পর্শ করতে পারেনি, তাঁকে কোন কালে। নিতাম

    মুক্ত - তাই পড়েননি মায়াজালে। ঈশ্বরকোটি—তাই সদাই বিচরণ করতেন এক ভাবের রাজ্যে। যদিও বা মন নামত সাধারণ ভূমিতে—ক্ষণেকের জন্য, পরক্ষণেই আবার উঠে যেত সেই উচ্চ ভূমিতে, স্বাভাবিক ভাবেই। তাই বুঝি অত বড় জ্ঞানী-শ্রেষ্ঠ, স্পর্শমাত্রে অন্যের মধ্যে জ্ঞানসঞ্চারে সক্ষম, শ্রীশ্রীঠাকুর যাঁকে সব দিয়ে ফকির হয়েছিলেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত বলেছিলেন, 'আধ্যাত্মিকতায় রাখাল আমাদের সকলের চেয়ে বড়।'

    শ্রীশ্রীঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে একদিন গঙ্গার দিকে চেয়ে দিব্য দৃষ্টিতে দেখলেন, গঙ্গায় একটি শতদল পদ্ম ফুটে উঠল। অপূর্ব শোভা তার ! কমলের দলে দলে কিশোর কৃষ্ণের হাত ধরে কিশোর বালক নৃত্য করছেন। দেখে ঠাকুর ভাবে বিভোর হয়ে গেলেন —কৃষ্ণসখা, ব্রজের রাখাল, রাখালরাজ দর্শন ক'রে। তারপর এলেন রাখাল-চন্দ্র, স্থূল দৃষ্টিতে দেখলেন ঠাকুর। ওদিকে দিব্য দৃষ্টির দর্শন, এদিকে স্থূল চোখের দেখা। ব্রজের রাখাল, রাখালচন্দ্র। দুইই এক, পূর্ণ সাদৃশ্য—অবিকল সেই কিশোর বালক।

    তাই ছিল ব্রজের দিকে তাঁর টান। ভয়ে আকুল হতেন ঠাকুর এই টান দেখে। যাঁর সম্বন্ধে বলতেন, ‘ওর মুখপানে চাও, দেখতে পাবে ঠোঁট নড়ছে, অন্তরে অন্তরে সদাই ঈশ্বরের নাম জপ করে—যাঁকে দেখলে ‘গোবিন্দ ! গোবিন্দ !’বলে মহাভাবে মগ্ন হয়ে যেতেন —যাঁকে না দেখলে, ‘মা, আমার রাখালরাজকে এনে দে! ব’লে জগন্মাতার কাছে কেঁদে আকুল হতেন— সেই রাখালচন্দ্র, যেখান থেকে এসেছেন সেখানে— ব্রজধামে গেলে, পাছে আর না ফেরে, তাই ভেবে ভয় পেতেন ঠাকুর। মায়ের কাছে প্রার্থনা করতেন, ‘যেতে চায় দুদিনের জন্য যাক্, কিন্তু চিরদিনের জন্য

    যেন না যায়’; বলতেন, ‘রাখাল সত্যি ব্রজের রাখাল যেন না যায়; বলতেন, 'রাখাল সত্যি ব্রজের রাখাল।

যে যেখান থেকে এসেছে শরীর ধারণ করে, সেখানে গেলে প্রায়ই তার শরীর থাকে না।' রাখালচন্দ্র শ্রীবৃন্দাবনে গেলে ঠাকুর নিশ্চিন্তে থাকতে পারেননি। ভক্তদের একে তাকে বলতেন, খোঁজখবর নিতে, চিঠি লিখতে। কতই ভয়, পাছে তাঁকে ছেড়ে চলে যায় – নিজের ধামে; পাছে আর না ফেরে। সেখানে তাঁর অসুখ হয়েছে শুনে, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মার কাছে বলতেন, ‘মা কি হবে? তাকে ভাল করে দে।

    কিছুকাল বাইরে কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন রাখালচন্দ্র। তারপর কতবার ব্রজে গেছেন, কত তপস্যা করেছেন। কখনও বৃন্দাবনে, কখনও কুসুম- সরোবরে, কখনও শ্যাম-কুণ্ড-রাধাকুণ্ডে, কখনও গিরিগোবর্ধনে। আহারের, বস্ত্রের, বাসস্থানের, তীর্থভ্রমণের ও তপস্যার কঠোরতা স্বেচ্ছায় বরণ করেছেন। এরই মধ্যে দিনের পর দিন ব্রজধামে ধ্যানে কাটিয়েছেন। ধ্যানের ভাবে উঠেছেন, বসেছেন, খেয়েছেন, শুয়েছেন, চলেছেন, ফিরেছেন।

    সাধক রাখালচন্দ্র, কখনও কখনও ঠাকুরকে পর্যন্ত বলতেন, ‘সময় সময় তোমাকেও আমার ভাল লাগে না।' তাই দূরে সরে গিয়ে, গভীর ধ্যানে ডুবে গিয়ে সব ভুলে যেতে চাইতেন। কিন্তু ঠাকুর সে রাজ্য থেকে ফিরিয়ে আনতেন তাঁকে। ছেলে যে –লোকে দেখবে; ছেলেকে দেখে তাঁকে দেখবে –স্থূল শরীরের অদর্শনের পর। কখনও ভুলতে পারতেন না, কখনও ছেড়ে যেতে পারতেন না ঠাকুরকে রাখালচন্দ্র। পিতাপুত্রে, আদর আবদারের । মধ্যে, মান-অভিমানের পালাও চলত; কখনও কখনও চরমে উঠত। অভিমানে ফুলে তখন দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে, ঠাকুরকে ছেড়ে, চলে যেতে চাইতেন রাখালচন্দ্র। যেতেনও খানিক দূর। কিন্তু ঐ পর্যন্ত, আর এগোতে পারতেন না। ফিরে আসতে হাত আবার সেই ঠাকুরের কোলে। এমনি টান ছিল। পিতার গুণ পুত্রে পায়, অন্ততঃ খানিকটা। ঠাকুরের গুণ পেয়েছিলেন রাখালচন্দ্র অনেকখানি। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাব হ'ত মুহুর্মুহু, রাখালচন্দ্রও সর্বদা ভাবে মগ্ন থাকতেন। দক্ষিণেশ্বরে, বলরাম-মন্দিরে, বেলুড়মঠে, কাশীতে, বৃন্দাবনে কখনও তা গভীরভাবে পরিণত হয়েছে। একবার বেলুড় মঠে কালীকীর্তন শুনে এত দীর্ঘ কাল-স্থায়ী গভীরভাব হয়েছিল যে, মা-ঠাকরুণ এসে মাথায় হাত বুলালে তবে ভাবের উপশম হয় ।

    তাঁর কাছে যাঁরা আসতেন, শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁদের সকলকে এমন ভালবাসতেন যে প্রত্যেকেই ভাবতেন, ঠাকুর তাঁকে অন্যের চেয়ে বেশি ভালবাসেন। পুত্রও এই গুণ অনেকাংশে পেয়েছিলেন। ছেলে-বুড়ো, মেয়ে-পুরুষ, সন্ন্যাসী- গৃহী, ধনী-নির্ধন, পণ্ডিত-মূর্খ, প্রত্যেকেই ভাবতেন মহারাজ তাঁকে যেমন ভালবাসতেন, অন্যকে তেমন ভালবাসেন না।

    ঠাকুরের ছিল মিষ্ট ব্যবহার, এত মিষ্ট যে সে ব্যবহার যিনি পেতেন, তিনিই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। (রাখাল) মহারাজেরও ছিল অতি ভদ্র বিনয়-নম্র ব্যবহার। সে ব্যবহারে প্রাণ জুড়িয়ে যেত। যেখানে যেখানে ঠাকুর যেতেন, সেখানকার আশে পাশের যত দেবস্থান তিনি দর্শন করতেন ও যথাসাধ্য পূজা দিতেন। মহারাজও কোথাও গেলে, সেখানকার দেবমন্দিরে দেবদর্শন ও পূজা নিবেদন ক'রে, তবে অন্য কাজ করতেন।

    মন্ত্র-উচ্চারণ, সামগ্রী নিবেদন ও যাবতীয় অনুষ্ঠানের দ্বারা যাতে দেবপূজা নিখুঁত ভাবে হয়, সেদিকে ঠাকুরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। মহারাজও পূজার প্রত্যেক অঙ্গ ও খুঁটিনাটির দিকে বিশেষ নজর রাখতেন, এবং সেগুলি ঠিক ঠিক শাস্ত্রীয় ভাবে, শুদ্ধ আচারে, যাতে অনুষ্ঠিত হয়—তার ব্যবস্থা করতেন।

ঠাকুর ছিলেন ত্যাগী-রাজ, মহারাজও ছিলেন সর্বত্যাগী। ঠাকুরের মন অনুক্ষণ ভগবদ্রাজ্যে বিচরণ করত; মহারাজ ঘন ঘন ভগবদ্ভাবে মগ্ন হতেন। সংসারের অনেক ঊর্ধ্বে ঠাকুর বিচরণ করতেন; মহারাজও ছিলেন সর্বপ্রকারে সংসারে নির্লিপ্ত।

    ঠাকুর বলতেন, সত্যকথা কলির তপস্যা- ভুলেও মিথ্যা বলতেন না। মহারাজ ঠাট্টার ছলেও মিথ্যা বলতে নিষেধ করতেন এবং সেইরূপ আচরণ করতে উপদেশ দিতেন। অন্যের পীড়া হয়, কষ্ট হয়, উদ্বেগ হয়, এরূপ আচরণ বা কথা বার্তা ঠাকুর পরিহার করতেন। মহারাজও কারও মনে কখনও কষ্ট দেননি, কাউকে কখনও ব্যতিব্যস্ত করেননি। এ সব শিক্ষা তাঁর শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে।

    একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন, 'রাখাল একটা রাজ্য চালাতে পারে!'—শুনেই স্বামীজী তাঁর নাম দিলেন 'রাজা' এবং এই নামেই তাঁকে ডাকতেন। এই জন্যই শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমণ্ডলী তাঁকে ‘রাজা মহারাজ’বলেন। ‘মহারাজ' নামেই তিনি সুপরিচিত। স্বামীজী রাখাল-চন্দ্রকে শুধু ‘রাজা’নাম দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের অধ্যক্ষ করে সে নাম সার্থক করেছিলেন। এমনকি আমেরিকা থেকে ফিরে এসে, টাকাপয়সা যা এনেছিলেন, সমস্ত মহারাজকে দিয়ে বলেছিলেন, রাজা, এ সমস্ত তোর, আমি কেউ নই।

    শ্রীশ্রীঠাকুর বুঝেছিলেন, ভক্ত-হৃদয়ে তিনি যে রাজ্যের বিস্তার আরম্ভ ক'রে গেলেন, সে রাজ্য পরিচালনা করতে রাখালরাজাই সমর্থ। ঠাকুর জানতেন, তিনি যে ‘শিবজ্ঞানে জীব-সেবা'র আদর্শ দিয়ে গেলেন, তাকে অবলম্বন করে নানা স্থানে কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর উপদেশ জীবনে অনুশীলন করে দেখাবার জন্য স্থানে স্থানে সাধুদের মঠ হবে, সে উপদেশ বিস্তারিত করে লোকের সামনে ধরবার জন্য দেশবিদেশে প্রচার-কেন্দ্র গড়ে উঠবে। এইভাবে প্রসারিত তাঁর ভাব-সাম্রাজ্য নিয়মিত ও যথাযথভাবে পরিচালিত করতে রাখালরাজাই পারবেন। তাই ঠাকুর রাখালচন্দ্রকে সেই ভাবে শিক্ষিত করেছিলেন। শুধু নামেই ‘রাজা’নয়, কাজেও রাজা হতে হবে রাখালচন্দ্রকে, তাই এই শিক্ষা ৷

    তাই দেখা যায় কত ভক্ত—কেহ বা সাধু, কেহ বা গৃহী, স্ত্রী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ, নানা দেশের, নানা ভাষাভাষী, তাঁর কাছে এসেছেন ধর্মলাভ করতে। আর মহারাজও তাঁদের প্রত্যেকের অন্তরের কথা, এমন প্রাণস্পর্শী ভাষায় ব'লে দিয়েছেন যে তাতেই তাঁরা সন্ধান পেয়েছেন নিজের ভেতরে— যথার্থ ধর্মের। এরই ফলে চিরকালের জন্য কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ হয়েছেন তাঁরা মহারাজের প্রতি, রাজার ন্যায় তাঁকে নিজেদের পরিচালক জ্ঞান করেছেন, রাজ - আদেশের ন্যায় তাঁর আদেশ পালন ক’রে গেছেন। মহারাজও তাঁদের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ ক'রে যাতে তাঁদের কল্যাণ হয়, উত্তরোত্তর আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়—তার জন্য চেষ্টা করেছেন।

    বেলুড়ে, কাশীতে আলমোড়ায়, মাদ্রাজে এবং আরও নানা স্থানে, শ্রীশ্রীঠাকুরের মঠ প্রতিষ্ঠিত হ’লে, যাতে ঠাকুরের আদর্শে, ত্যাগ-তপস্যার ভাব নিয়ে সে সব মঠ চলে, সেদিকে দৃষ্টি রেখেছেন, সে বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। মঠবাসী সাধুদের জীবন যাতে এই আদর্শ অবলম্বনে উন্নততর হয় তার জন্য অনেক উপদেশ দিয়েছেন। আবার নিজে করে দেখিয়েছেন, কিভাবে সে আদর্শ কার্যে পরিণত করতে হয়।

    যখন কাশীতে ও কনখলে কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন সেখানে বাস ক'রে অনুভব করেছেন -জীবরূপী শিবের সেবা সেখানে হচ্ছে। কর্মীদেরও সে সত্য অনুভব করতে বলেছেন। সে-সব কর্মও ভগবৎসাধনা, তাতেও ভগবান লাভ হয়, সবই শ্রীশ্রীঠাকুরের কাজ—এই সত্য বারংবার প্রকাশ ক'রে, কর্মীদের মন থেকে সন্দেহ ও অবসাদ দূর ক'রে বিশ্বাস ও উদ্দীপনা এনে দিয়েছেন। যেখানে যেখানে কর্মকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে-সব জায়গাতেই এই আদর্শে কেন্দ্রগুলি গড়িয়ে তুলেছেন, কর্মীদের জীবন গঠিত করিয়েছেন শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবে—ত্যাগ-তপস্যার, শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শে।

    মায়াবতী অদ্বৈতাশ্রমে, উদ্বোধনে, মাদ্রাজ মঠে, শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাব-প্রচারের উদ্দেশ্যে—স্বামীজীর গ্রন্থাবলী ও ‘উদ্বোধন’‘প্রবুদ্ধ ভারত' প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশের আয়োজন যখন হয়েছে, তখন তিনি দেখেছেন ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী এ যুগের বেদ; স্বামীজীর মধ্য দিয়ে তার ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে। ঠাকুরের শিষ্যদের অনেকের মধ্য দিয়ে সে বাণী প্রচারিত হবে বিভিন্ন ভাবে। অনেকে আলোচনা করবে, ব্যাখ্যা করবে সে বেদবাণী, সে ভাষ্য – সে বিভিন্ন ভাব—নানা দেশে, নানা দিক থেকে। সে- সব জেনে লোকের কল্যাণ হবে। এ যুগের বাণী ভগবান কি জন্য কি ভাবে দিয়েছেন, বুঝে আলোর সন্ধান পাবে। সে আলো জীবনের অন্ধকার দূর করবে, জীবন ধন্য করবে। এই ভাবে দেখে তিনি সেসব পরিচালনা করার নির্দেশ দিতেন ও গড়ে তুলতেন।

    এই ভাবে তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবরাজ্যের পরিচালনা এবং প্রসার অক্ষুণ্ণ রেখে ঠাকুরের আদর্শে, তাঁর ভাবে, সে রাজ্যকে সুগঠিত করে ছিলেন। এই রাজ্যের মধ্যে ছিল প্রাণঢালা ভালবাসা, অকৃত্রিম স্নেহ। সে স্নেহ, সমস্ত বাধাবিঘ্নকে ভেঙে চুরে সরিয়ে, নিজের গতিকে অব্যাহত রেখে, উদ্দেশ্য আমার ছেলে রাখাল আছে, সেখানে যা, শান্তি পাবি ।' Bap আমার কে ঠাকুর? কে রাখাল ? কিছুই জানা ছিল না তাঁর। নিজের মায়ের কাছে সন্ধান নিয়ে গেলেন বাগবাজারে — উদ্বোধন কার্যালয়ে স্বামী সারদানন্দের সমীপে, সেখান থেকে প্রেরিত হয়ে বলরাম মন্দিরে মহারাজের কাছে গেলেন তিনি। দুপুরে খাওয়ার পরে বিশ্রামের সময় বালিকাটি হাজির। মহারাজ তাঁর সব কথা শুনে, উপদেশ ও দীক্ষাদি দিয়ে জীবনে শান্তি দান করলেন; সেদিন আর বিশ্রাম করা হ'ল না। চিনলেন বালিকা শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে; চিনলেন তাঁর ছেলে রাখাল—তাঁর মানসপুত্ৰ স্বামী ব্রহ্মানন্দকে। এইভাবে অনেকেই চিনেছিলেন তাঁদের।

    সিদ্ধ করে চলে যেত। ফলে দেখি তাঁর দিকে আকৃষ্ট সকল কর্মী, সন্ন্যাসী ও ভক্ত—শুধু বাংলায় নয়, ভারতের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে, ভারতের বাইরে—সিংহলে,ব্রহ্মদেশে, আমেরিকায়, ইংলণ্ডে, আরও কত দেশে। আনন্দে তাঁরা ছড়াতে লাগলেন এই ভাব মহারাজকে কেন্দ্র ক'রে। গড়ে উঠল এই ভাবে এক সাম্রাজ্য। যার সূচনা করে গিয়েছিলেন পিতা, তাকে গড়ে তুললেন উপযুক্ত পুত্র—তাঁর ‘মানসপুত্র' স্বামী ব্রহ্মানন্দ। পরিষ্কার ক'রে দিয়ে গেলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাব সকলের সামনে। মেনে নিলেন সকলে অবনত মস্তকে সে-সব। দীর্ঘকাল নিকট সাহচর্যবশতঃ পুত্র পিতার ভাব জানতেন । ঠাকুরের কাছে কাছে অনেকদিন থাকায় মহারাজ জানতেন তাঁর ভাব ভাল করেই। তাই মহারাজ দিতে পারলেন একটি ছাঁচ, ঠাকুরের ভাব-পরিচালনার, ভক্ত-পরিচালনার, কর্ম-পরিচালনার—শুধু পরিচালনার নয়, গঠনের। যে ছাঁচে ফেলে এখনও চলেছে কাজ চারিদিকে। 

    পুত্র তাঁরই কাজ করছেন—একথা স্থূল শরীরের অদর্শনের পরও শ্রীশ্রীঠাকুর জানিয়ে দিয়েছিলেন— দিব্য শরীরে দর্শন দিয়ে দিব্য বাণীতে কথা বলে, শুধু নিজের সন্ন্যাসী শিষ্যদের বাছা বাছা কাউকে নয়—অতি সাধারণ লোককেও। একবার এক বাল- বিধবা জীবনে কিছুই হল না, জীবন বুঝি বৃথা গেল ভেবে আকুল হয়ে কাঁদছিলেন কদিন ভগবানের কাছে। দেখলেন এই সময়, বলছেন শ্রীশ্রীঠাকুর গভীর রাত্রে দেখা দিয়ে, ‘কাঁদছিস্ কেন? বাগবাজারে

    শ্রীশ্রীঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে পঞ্চবটীমূলে, এক সময় ভাবচক্ষে যে বালককে দেখেছিলেন, সেই বালকভাবেই কাটিয়ে গেলেন মহারাজ চিরকাল। শ্রীমা মঠে এলে মহারাজ তাঁর কাছে কাছে ঘুরতেন । কাশীধামে শ্রীমা যেখানে থাকতেন, সেখানেও মহারাজ ঐ ভাব নিয়ে যেতেন। ছেলেকে শ্রীমাও ভাল কাপড় দিতেন। শ্রীমা জয়রামবাটী থেকে আসছেন শুনে শিশুর মতই মহারাজ দেখা করতে যেতেন। এই রকম শিশুভাবে এমন ডুবে থাকতেন যে, যিনি দেখতেন তিনিই ভাবতেন যেন ছোট্ট ছেলেটি। তখন তাঁর মধ্যে অধ্যক্ষ, মহারাজ, গুরু, রাজা—এদের কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হত। এই ভাব নিয়েই মানসপুত্র কাটিয়ে গেছেন সারাজীবন।